সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৭ পূর্বাহ্ন
সমকাল : করোনাভাইরাসের কারণে তৈরি হওয়া সংকট কাটাতে শিল্প ও সেবা খাতের জন্য ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণের জন্য কাড়াকাড়ি শুরু হয়েছে। বড় গ্রাহকদের চাহিদা বিবেচনায় বিভিন্ন ব্যাংক এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের অনাপত্তির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেদন করেছে। তবে বিপরীত চিত্র কুটির, অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএমএসএমই) খাতের ঋণে। এ খাতের জন্য ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না বললেই চলে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২০০ কোটি টাকার ঋণ দিয়েছে ছয়টি ব্যাংক। ব্যাংকাররা বলছেন, এসএমই ঋণে আবেদন কম আসছে। অন্যদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে ছোট উদ্যোক্তারা ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পাচ্ছে না।
করোনাভাইরাসের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন খাতের জন্য এক লাখ তিন হাজার কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এর বেশিরভাগই ব্যবসায়ীদের জন্য সরকারের সুদ ভর্তুকির আওতায় ব্যাংকগুলো নিজেদের মতো করে ঋণ দেবে। শিল্প ও সেবা এবং সিএমএসএমই খাতে ব্যাংকগুলো যে ঋণ দেবে তার অর্ধেক পুনঃঅর্থায়ন করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ঋণ আদায়সহ পুরো দায়ভার থাকবে ব্যাংকের ওপর। ব্যাংক এসব ঋণের বিপরীতে ৯ শতাংশ সুদ পাবে। তবে শিল্প ও সেবা খাতের সুদের অর্ধেক তথা সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি দেবে সরকার। বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ গ্রাহককে দিতে হবে। সিএমএসএমই খাতে সরকার ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি দেবে। আর ৪ শতাংশ গ্রাহকের কাছ থেকে নিতে হবে। বড়দের তুলনায় ছোট গ্রাহকরা কম সুদে ঋণ পাবে।
সিএমএসএমই খাতে প্রণোদনার ঋণ পাওয়ার সহযোগিতা চেয়ে এরই মধ্যে তিন শতাধিক উদ্যোক্তা ঢাকা চেম্বারের কাছে আবেদন করেছে। এসব আবেদন ব্যাংকগুলোতে পাঠাবে ডিসিসিআই। কোনো অসহযোগিতার খবর পেলে বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করবে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন- ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ঘোষিত প্যাকেজ বাস্তবায়নে কোনো কোনো ব্যাংক সহযোগিতা করছে না। এ ধরনের ব্যাংক থেকে সরকারি আমানত তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি শামস মাহমুদ সমকালকে বলেন, চলতি মূলধন সহায়তা ছাড়া এই মুহূর্তে ব্যবসা পরিচালনা করা সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য খুব কষ্টকর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না- এমন প্রচুর অভিযোগ আসছিল। এ অবস্থায় ডিসিসিআই সদস্যদের সমস্যা সমাধানে আলাদা একটি ডেস্ক খোলা হয়েছে। যাদের ঋণ দরকার তারা সেখানে আবেদন করবেন। এরপর ডিসিসিআই থেকে ওইসব উদ্যোক্তার সব কাগজপত্র ঠিক করে ব্যাংকে পাঠানো হবে। এর পরও ব্যাংক শাখা যদি ঋণ না দেয়, তখন প্রধান কার্যালয়কে অবহিত করা হবে। তার পরও ঢিলেমি করলে তখন বাংলাদেশ ব্যাংককে জানানো হবে।
জানা গেছে, সিএমএসএমই খাতে এখন পর্যন্ত ঋণ দিয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ও বাংলাদেশ কৃষি, বেসরকারি খাতের শাহজালাল ইসলামী, মার্কেন্টাইল, ট্রাস্ট ও সিটি ব্যাংক। এর মধ্যে সিটি ব্যাংক ২৭ কোটি টাকা বিতরণ করে তার অর্ধেক তথা সাড়ে ১৩ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে আবেদন করেছে। আর গত মঙ্গলবার পর্যন্ত বড় উদ্যোক্তাদের মাঝে ব্যাংকগুলো সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা ঋণ ছাড়ের অনাপত্তির জন্য পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকে। এর মধ্যে তিন হাজার ৫০৬ কোটি টাকার বিপরীতে অনাপত্তি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আরও তিন হাজার কোটি টাকা অনাপত্তির প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম সমকালকে বলেন, ব্যাংক শুধু ব্যবসার জন্য নয়, গ্রাহকের সমস্যায় পাশে দাঁড়ানোও ব্যাংকের দায়িত্ব। সাধারণভাবে করপোরেট শাখা থেকে বড় ঋণ দেওয়া হয়। যে কারণে এসব প্রস্তাব প্রধান কার্যালয়ে দ্রুত আসে। আর বাইরের বা গ্রামীণ শাখা থেকে সিএমএসএমইর বেশিরভাগ ঋণ দেওয়া হয়। যে কারণে ওই প্রস্তাব আসতে দেরি হয়। আবার বর্তমানে অনেক কর্মকর্তা অসুস্থ থাকায় হয়তো কিছু সমস্যা হচ্ছে। শিগগিরই পুরোদমে সব পর্যায়ের ঋণ কার্যক্রম শুরু হবে।
শাখা পর্যায়ের কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় ঋণ গ্রহীতা যেভাবে ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করতে পারে, ছোটরা তা পারে না। অনেক সময় বড়দের জন্য বাংকের চেয়ারম্যান, প্রভাবশালী পরিচালক বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সুপারিশ করেন। ছোটদের জন্য সুপারিশ তো দূরে থাক, অনেক ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করা হয়। বিশেষ করে সব ঋণে ৯ শতাংশ সুদহারের সীমা ঠিক করে দেওয়ার পর এসএমই খাতে বেশি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি সিএমএসএমই খাতের অনেক উদ্যোক্তা এই পরিস্থিতি কবে ঠিক হবে, ব্যবসা করে ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারবেন কিনা- এসব চিন্তা থেকে এই মুহূর্তে ঋণ নিতে চাইছেন না।
সরকারের সুদ ভর্তুকির আওতায় শিল্প ও সেবা খাতে প্রণোদনা ঋণের চাপ সামলাতে গত ২৫ জুন একটি সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রথম বছরেই অনেক উদ্যোক্তা যেন ভর্তুকি ঋণের সুবিধা পান সে জন্য একজন গ্রাহকের প্রাপ্য ঋণ একবারের পরিবর্তে তিন বছরে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মানে সুদ ভর্তুকির আওতায় একজন উদ্যোক্তা ২০১৯ সালের চলতি মূলধন ঋণ স্থিতির যে ৩০ শতাংশ সুবিধা পাবেন, তা তিন বছর ধরে নিতে পারবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আবু ফরাহ মো. নাছের সমকালকে বলেন, করোনাভাইরাসে ক্ষতিগ্রস্ত অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে ভর্তুকি সুদে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে অর্থনীতি গতিশীল ও পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে নীতিমালায় সংশোধনী আনা হয়েছে। কেননা একবারের বেশি এ তহবিলের সুবিধা নেওয়া যাবে না- এই নির্দেশনার ফলে অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন। এখন ভেঙে ভেঙে সুবিধার সুযোগের ফলে হয়তো যেটুকু না হলে নয়, সেই অংশের জন্য আবেদন করবেন। এতে প্রথম বছরেই অনেকেই সুবিধা পাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ব্যাংকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের অসহযোগিতার অভিযোগ অনেক পুরোনো। সমস্যা সমাধানের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৎপর রয়েছে। এসএমই খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, হেল্পডেস্ক স্থাপনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এখন ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিমসহ আরও কী কী করা যায় তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
.coxsbazartimes.com
Leave a Reply